ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো রক্তাক্তক অবস্থা
গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় প্রচুর শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। সংঘর্ষের সময় হামলা, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার এবং ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই সংঘর্ষে প্রায় তিন শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। নারী শিক্ষার্থীরাও এই হামলা থেকে বাদ যাননি।
পেজ সূচিপত্র: ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা হয়েছে মেডিকেলের জরুরি বিভাগে। এই ধরনের ঘটনা সাধারণত রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে ঘটে থাকে এবং এর সমাধানের জন্য প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও তৎপর হতে হবে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের সময়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সামনের সারিতে উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
এতে ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন, সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতসহ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের নেতারা যুক্ত ছিলেন।এই ঘটনার প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারা দেশে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছে।
দুপুরে রাজু ভাস্কর্যে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ সমাবেশ চলাকালে বিজয় একাত্তর হলে শিক্ষার্থীদের আটকে রাখার খবর আসে। তখন শিক্ষার্থীরা হলের দিকে গেলে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায় এবং ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোটা, রড, হকিস্টিক, পাইপ, স্টাম্প নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। নারী শিক্ষার্থীরাও এই হামলার শিকার হন।
সংঘর্ষের সময় মধুর ক্যান্টিন থেকে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের নেতাকর্মীদের নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। শিক্ষার্থীরা মল চত্বর থেকে ভিসি চত্বরের দিকে পিছু হটে। ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, জামায়াত-শিবির ও বিএনপি’র চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন হলে প্রবেশ করে ভাঙচুর ও হামলা চালিয়েছে
এবং এতে ছাত্রলীগের অন্তত ২৫ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। তাদের বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, তারা বলেন যে, রাজাকার স্লোগান দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে তারা কলঙ্কিত করেছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাজনৈতিক নেতাদের আরও সতর্ক ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হামলা প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। সংঘর্ষের পরে, আন্দোলনকারীরা সরে গেলে ছাত্রলীগ টিএসসি, ভিসি চত্বরসহ পুরো ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং স্লোগান দিতে দিতে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করতে থাকে। মহানগর থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা টিএসসি’তে আসতে থাকে এবং ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক
শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের নেতৃত্বে তারা ভিসি চত্বরের দিকে এগোতে থাকেন। এসময় বেগম রোকেয়া হলের শিক্ষার্থীরা থালাবাসন বাজিয়ে ‘ভুয়া’, ‘টোকাই’, এবং ‘গো-ব্যাক’ স্লোগান দেন। দুপুর ১২টা থেকে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান নেন
এবং ‘তুমি কে আমি কে - "রাজাকার" রাজাকার" কে বলছে কে বলেছে - সরকার সরকার" লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা কারও বাপের না’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি নই, আমি নই - রাজাকার রাজাকার’, ‘ভয় দেখিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’ ইত্যাদি
স্লোগান দিতে থাকেন। এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল এবং আশেপাশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যোগ দেন। এই পরিস্থিতিতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ, এবং রাজনৈতিক নেতাদের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি যাতে ভবিষ্যতে এমন সংঘর্ষ ও সহিংসতা এড়ানো যায়
এবং শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা তপ্ত দুপুরের রোদে পুড়ে বিভিন্ন দাবিতে স্লোগান দিতে থাকেন। তাদের প্রধান দাবিগুলির মধ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রত্যাহার এবং সংসদের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করে কোটা সংস্কারে আইন পাস করা।
একই স্থানে বেলা ৩টায় ছাত্রলীগ তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘোষণা দেয় এবং মধুর ক্যান্টিনে অবস্থান নেয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "আপনি ২ শতাংশ নিয়ে পড়ে আছেন। ৯৮ শতাংশকে বানিয়ে দিলেন রাজাকার। একটা দেশের ৯৮ শতাংশ শিক্ষার্থী রাজাকার হতে পারে না।
আপনার বক্তব্য কল্পনাপ্রসূত। অতিদ্রুত বক্তব্য প্রত্যাহার করুন।" তিনি ছাত্রলীগকে উদ্দেশ্য করে বলেন, "পদ যেদিন চলে যাবে তখন কেউ ভাইকে চিনবে না। আপনাদের আহ্বান জানাই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন। আপনার লেখাপড়া আর কতোদিন? পায়ের জুতা নেতাদের পেছনে ক্ষয় না করে পড়াশুনায় মনোনিবেশ করুন। সময় গেলে আর করার কিছুই থাকবে না।
পদ চলে গেলে হলের সিটটাও থাকবে না।" প্রথম দফার সংঘর্ষ শেষে বিকাল ৫টার দিকে শহীদুল্লাহ হলের সামনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের দ্বিতীয় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। দুইপক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপে বেশ কয়েকজন আহত হন। এ সময় ১০টির অধিক ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে এবং আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছাত্রলীগের কর্মীদের দেখা যায়।
সংগঠনের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর লাঠি-সোটা, রড, স্টাম্প, হকিস্টিক দিয়ে হামলা চালান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের সময় শহীদুল্লাহ হল ও ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা ভেতরে অবস্থান নেন। অন্যদিকে ছাত্রলীগ ঢাকা চানখাঁরপুল মোড় ও দোয়েল চত্বরের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীদের
দিকে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকে। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ইটপাটকেল ছুড়ে। দুই পক্ষের সংঘর্ষে ওই এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এরই মধ্যে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে গিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। এতে মেডিকেলের ভেতরে আতঙ্ক শুরু হয় এবং অনেক শিক্ষার্থী আহত হন।
ছাত্রলীগ একই সময়ে শহীদ মিনার, ফুলার রোডসহ আশপাশের এলাকায় সন্দেহ হলেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালিয়েছে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে দোয়েল চত্বর দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে পুলিশ। ডিএমপি যুগ্ম-কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের নেতৃত্বে পুলিশ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। এ সময় শহীদুল্লাহ হলের প্রভোস্ট
কিছুক্ষণ পর প্রক্টর প্রফেসর ড. মো. মাকসুদুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, "আমাদের হাতে সবকিছু নেই। সুযোগ থাকলে আমরা বহিরাগতদের আগেই সরিয়ে দিতাম। এখন আমরা হল প্রভোস্ট ও হাউস টিউটরদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের হলের ভেতরে প্রবেশ করিয়ে বহিরাগতদের বের করার ব্যবস্থা করবো।" শিক্ষার্থীদের হলে ঢোকানোর আগে বহিরাগতদের বের করাটা কঠিন হচ্ছে।
রাতে এ রিপোর্ট লেখার সময় শিক্ষার্থীরা শহীদুল্লাহ হলের সামনে অবস্থান করছিলেন। সেখান থেকে ৩০ গজ দূরে একটি সাঁজোয়া যান (এপিসি) নিয়ে কয়েকশ’ পুলিশ সদস্য অবস্থান নিয়ে ছিলেন। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হল গেট থেকে দোয়েল চত্বরের দিকে নিয়ে যায় পুলিশ। আহত শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে প্রক্টর বলেন,
"কত শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন তার সঠিক পরিসংখ্যান এখন আমরা বলতে পারি না। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। আহত সব শিক্ষার্থীকে সুচিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।" সংঘর্ষের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে বলেও জানান তিনি।
সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বিরোধীদের বিক্ষোভ আজ
তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, দাবি মানা না হলে বিক্ষোভ থেকে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। গতকাল দিনভর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষের পর সন্ধ্যা ৬টার দিকে শহীদুল্লাহ হলের সামনে সাঁজোয়া যানসহ কয়েকশ পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
সংঘর্ষের পর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা হলের গেটের ভেতরে অবস্থান নেন এবং বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। হলের প্রভোস্ট ড. মোহাম্মদ জাভেদ হোসেন শিক্ষার্থীদের হলে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ করলেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন।
পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে কোটা আন্দোলনকারীদের একটি মিছিল দোয়েল চত্বরের দিকে আসলে পুলিশের সঙ্গে তাদের প্রতিনিধি দল কথা বলেন। আন্দোলনকারীরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সংবাদ সম্মেলন করতে চাইলে পুলিশ তা নিষেধ করেন। পরে তারা দোয়েল চত্বরেই সংবাদ সম্মেলন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেন, "শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারাদেশে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়েছে। আমরা মনে করি এই হামলা পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ছাত্রলীগ পরিকল্পনা করছে এই আন্দোলনকে সহিংসভাবে দমন করার জন্য। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই
এভাবে এই আন্দোলনকে দমন করা যাবে না। আমাদের কর্মসূচি ছিল শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অবমাননাকর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবিতে। আমরা এখনো বলতে চাই, আমরা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করি।
নাহিদ আরও বলেন, "আমরা সারাদেশের মানুষের কাছে আহ্বান করব, আপনারা নেমে আসুন। শিক্ষার্থীরা নেমে আসুন, সাধারণ মানুষ নেমে আসুন। শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার বিচার আদায় করুন। সারাদেশের সব মানুষকে আহ্বান করব আমাদের মিছিলকে বড় গণজমায়েত তৈরি করুন।
বৃহত্তর গণআন্দোলনের দিকে আমাদের যেতে হবে। এটা আর ছাত্রদের আন্দোলন নাই, এই আন্দোলনে যখন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উস্কানি দিয়ে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করা হয়েছে। সাধারণ মানুষকে এ আন্দোলনে নেমে আসতে হবে। এরপর আমরা সারাদেশে অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করব।"আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন
ইসরাত টেক আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url